পেশা বদলাতে চায় বিহারি তরুণরা
হিটলার এ. হালিম
পুরনো পেশা বদলে নুতন পেশায় যেতে চায় বিহারি তরুণরা। নরসুন্দরের কাজ (নাপিতের কাজ), শাড়ির কারচুপির কাজ, বেনারসি শাড়ি তৈরি, জরির কাজ, কাবাব তৈরি, জুতা তৈরি, বাসের হেলপারি, কন্ডাক্টরি কিংবা গাড়ি চালানোর কাজ বাদ দিয়ে তারা নতুন কাজ করতে আগ্রহী। যে কাজে আয় বেশি সেই কাজ করে ক্যাম্পের বাইরে বাসাভাড়া নিয়ে জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে চায় তারা।
দেশের ১৩ জেলার ৭৬টি ক্যাম্পের অধিকাংশ বাসিন্দা এসব পেশায় নিয়োজিত। তবে চট্টগ্রামের ক্যাম্পগুলোর বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী পোশাক কারখানায় কাজ করে বলে জানা গেছে। কথা হলো মিরপুরের ১২ নম্বরের মেডিকেল ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইকবালের সঙ্গে। তিনি পেশায় একজন নরসুন্দর। কাজ করেন মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরের একটি সেলুনে। তার দুটি সন্তান। ক্যাম্প ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। মাস কয়েক যেতে না যেতেই ভাড়া বাসা ছেড়ে আবার তাকে পুরনো ক্যাম্পেই ফিরতে হয়েছে। বললেন, ‘যে টাকা আয় করি তা দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারিনি। ব্যবসা করতে পারলে ক্যাম্পে আর ফিরতাম না। কিন্তু করব কিভাবে। পুঁজি নেই যে!’ তিনি জানান, তাদের ক্যাম্পে দেড় শতাধিক পরিবারে আছে ২ হাজারের মতো সদস্য। আগের চেয়ে বর্তমানে ক্যাম্পের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তাদের মূল সমস্যা এখনো দূর হয়নি। জানালেন, তাদের মধ্যে যাদের অবস্থা ভালো তারা ব্যবসা করে ভালোভাবে দিন কাটাচ্ছেন। মিরপুরের বেনারসি পল্লীর অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের গোত্রের। অথচ পুঁজির অভাবে অনেকে চাইলেও কোনো ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না।
নারায়ণগঞ্জের আদমজীতে প্রায় ৩৭ একর জায়গাজুড়ে জেনেভা ক্যাম্প অবস্থিত। ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে অনেকে চাকরি, ব্যবসা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিযোগ করলেন, আদমজী ইপিজেডে বিহারিদের চাকরি দেয়া হয় না জাতীয় পরিচয়পত্র নেই বলে। ফলে চাইলেও এখানকার তরুণরা নতুন কোনো পেশায় যেতে পারছে না। তবে বিহারিদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন সূত্রে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেল। বিহারি তরুণরা ক্যাম্পের বাইরের জীবনে যেতে চায় না। কারণ ক্যাম্পে থাকলে জাতিসংঘ, ওআইসি, রাবেতাসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে সাহায্য সহযোগিতা পায়। বিদ্যুৎ, পানির বিল লাগে না, লাগে না বাসা ভাড়া। ক্যাম্পের বাইরে গেলে ওইসব সুবিধা পাওয়া যাবে না এমন আশঙ্কা থেকেও তারা বাইরে যেতে চায় না। ফলে যে তিমিরে তাদের জন্ম সেই তিমিরেই তারা থেকে যায়। যারা নিজেদের মর্যাদার কথা ভাবে, অল্পবিস্তর পড়াশোনা শেখে তারা চাকরিসহ অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউসেফ স্কুলের মিরপুর শাখায় (কালশী এলাকা) ৬০-৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী মিরপুরের বিভিন্ন ক্যাম্পের। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণ ফ্রি এই স্কুলে। এই স্কুলেরই শিক্ষক শিরিন আফরোজ জানান, ওরা পড়াশোনায় মধ্যম মানের। কিন্তু তারা আরো ভালো করতে পারত। শিক্ষার্থীরা সবাই কাজ করে। বেশির ভাগই ঘরে বসে শাড়ির কারচুপির কাজ করে। এছাড়া জুতা বা অন্যান্য কারখানায়ও তারা কাজ করে। তিনি বললেন, ‘অনেক সময় ক্লাসে শিশুদের ঘুমাতে দেখা যায়। জিজ্ঞেস করলে বলে, রাত জেগে কারচুপির কাজ করেছে সেই কারণে ঘুম পাচ্ছে।’ তিনি জানান, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও কাজ করে। তিনি মনে করেন, একেক পরিবারের বেশি সন্তান থাকার পেছনে এটাও একটা কারণ যে, জন্ম দিলেই তো তারা কয়েকদিন পর থেকে আয় করতে শুরু করবে। এই প্রতিষ্ঠানে বছরে শিক্ষার্থী ড্রপআউটের (ঝরেপড়া) হার ৫ শতাংশের মতো। তবে এর মধ্যেও অনেকে পড়াশোনায় ভালো করছে। যারা ভালো করছে তারা কারিগরি শিক্ষা নিয়ে পেশা বদলিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। শিরিন আফরোজ ইউসেফের খুলনা শাখায় কাজ করতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে জানান।
এদিকে বিহারিদের নিজে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি বিহারি পুনর্বাসন সংসদের (বিবিআরএ) প্রধান পৃষ্ঠপোষক নিয়াজ আহমেদ খান অভিযোগ করলেন, বিহারি শিশু-কিশোররা আরো ভালো কাজ করতে পারত কিন্তু অবাঙালি ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটি বা রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যানদের কারণে শিশু-কিশোররা পড়াশোনা করতে পারছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলে, ত্রাণ কমিটির নেতারা (চেয়ারম্যানরা) দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় বসে আছেন। তারা চান না বিহারিরা স্কুল-কলেজে পড়–ক। পড়াশোনা করে তারা শিক্ষিত হয়ে আসে তাহলে তো কমিটির নেতাদের তারা মানবে না। তারা নিজেরাই সব করবে। এ আশঙ্কা থেকে তারা শিশু-কিশোরদের পড়ার প্রতি আগ্রহ কম দেখান। পড়াশোনা করতে দিতে চান না। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিরপুরের ১১ নম্বর ক্যাম্পের নেতা সরফরাজ আলম, ১০ নম্বর সেকশনের ক্যাম্পের মোহাম্মদ আব্বাস ও ১২ নম্বর ক্যাম্পের জালাল উদ্দিন্ন ভন্টু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন